কবি-সাহিত্যিক মানেই সন্ন্যাসী গোছের মানুষ কিংবা একদম জাত ভবঘুরে এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করে থাকেন। তবে অনেক বাঘা বাঘা সাহিত্যিকও যে ছাপোষা জীবনযাপন করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের মধ্যকার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ কবি জীবনানন্দ দাশ।
১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ের ওপরে মাস্টার্স শেষ করে জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়েছেন বেকার জীবনযাপন করে। অন্য কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে বেকারত্ব এক রকমের স্বেচ্ছায় বরণ করা জীবন পদ্ধতি হলেও জীবনানন্দকে দেখা গেছে চাকরির জন্য ভয়াবহ রকমের হাহাকার করতে।
লাবণ্য দাশকে বিয়ের আগে জীবনানন্দ দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করতেন। বিয়ের পর পরই চাকরি হারান জীবনানন্দ। একমাস না দুইমাস না, পাক্কা পাঁচ বছর বেকার ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার নির্জনতম এ কবি। বাঙালি পুরুষ বিয়ের পর পাঁচ বছর বেকার; সংসারের যে বেহাল দশা হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। লাবণ্য বিয়ে করেছিলেন একজন অধ্যাপককে কিন্তু বিয়ের পরে দেখা গেল স্বামী তার বেকার কবি। বাঙালি নারীর ভাত-কাপড়ের স্বপ্নের সঙ্গে লাবণ্যের মানসিকতা ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। কিন্তু বেকার কবির মেলানকলিক জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হতে খুব বেশি দিন সময় নেয়নি।
এরপর নানা সময়ে নানা জায়গায় অধ্যাপনা করেছেন জীবনানন্দ। হঠাৎ হঠাৎ চাকরি হারিয়েছেন। কখনওবা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন, বন্ধুর চলার পথে আহত পথিকের মতো হেঁটে বেড়িয়েছেন। বাঙালি বাস্তবতা কচ্ছপের মতো নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকা কবিকে যতবার টেনে আটপৌরে সংসারমুখী মানুষ করতে চেয়েছে, ততবার এ স্বাভাবিকতার সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে বেখাপ্পা অনুভূতির শিকার হয়েছেন বনলতা সেনের স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দের বয়স যখন পঞ্চাশের কোটা পেরিয়ে গেছে; একদিকে বেকার জীবন, অন্যদিকে সংসারের দহন- এক অস্বাভাবিক স্নায়ুচাপে জর্জরিত কবিকে দেখা গেছে সামান্য আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য জনে জনে হাত পেতে বেড়াচ্ছেন। যে কবি ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় লিখেছেন-
“অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;”
সেই কবিকে পাঠক দেখতে পান একটুখানি আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য, স্বচ্ছলতার জন্য কাঙালের মতো পাঞ্জাবি, ধুতি ও পাম্প শু পায়ে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিতদের একটি চাকরি জন্য দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করে চিঠি লিখেছেন। ল্যান্সডাউনের ঘরে ফিরেছেন আহত ও পরাজিত মানুষ হয়ে।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর জীবনানন্দ দাশ কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন। ওটাই তার জীবনে প্রথম ও শেষ দুর্ঘটনা। অনেকে বলেন আত্মহত্যা, অনেকে বলে বেখায়েলি হয়ে হাঁটার ফলে দুর্ঘটনাকবলিত। এত বছর পরে এসেও কোনটি সত্য তা এখনো রহস্য। তবে মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ ১৫ অক্টোবর কী কী করবেন নিজের ডায়েরির শেষ লেখায় তার একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। আত্মহত্যা হলেও এটা যে খুব পরিকল্পিত এমন না। মরতে চেয়েছেন জীবনানন্দ বহুবারই তবে সেদিনই যে ট্রামের নিচে ডাব হাতে দাঁড়িয়ে পড়বেন এটা হয়তো মিনিটখানেক আগে তিনি নিজেও ভাবেননি।
জীবনানন্দ তার ডায়েরির শেষ এন্ট্রিতে ভাবগাম্বীর্যপূর্ণ কিছুই লেখেননি। ডায়েরির শেষ এন্ট্রি দেখলে বোঝা যায় কতটা ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন নিজের তিতকুটে জীবনের প্রতি। সেখানে লিপিবদ্ধ ছিল সিগনেট প্রেসে যাওয়ার পরিকল্পনা, একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে চিঠি লেখার কথা, বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা, তারাশঙ্কর-সজনীকান্তের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার চেষ্টা, হাবরা কলোনিতে জমির খোঁজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকের চাকরির জন্য শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় ও মোহিনী ভট্টাচার্যের ধরনা দেয়া।
ডায়েরির শেষ লেখা থেকেই বোঝা যায় একজন কবির নাম জীবনানন্দ; অথচ অর্থগত জায়গা থেকে তার নামখানাই কতবড় উপহাস ঠেকেছিল তার কাছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি বাসস্থানের বন্দোবস্ত ও চাকরির ব্যবস্থার জন্য দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত কবি আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা পাঁজর নিয়ে শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন কলকাতার শম্ভুনাথ হাসপাতালে।
মৃত্যুর বছর জানুয়ারিতে শিক্ষাবিদ ও লেখক হুমায়ুন কবিরকে (যে পরবর্তীতে দু’দফায় ভারতের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন) লেখা এক চিঠিতে জীবনানন্দ বলেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভারত সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবে আপনি ভালই করছেন। আমার জন্য কিছু একটা এখুনি করুন। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ডিপিআই’র সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি বলেছেন, কোনো কলেজের প্রিন্সিপালের পদ এ মুহূর্তে খালি নেই, খালি হলে জানাবেন। কিন্তু যদি খালি হয়ও এবং চাকরিও পেয়ে যাই, প্রিন্সিপালের বেতন এমন আহামরি কিছু নয়। নতুন কোনো জীবিকা যেমন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আমার জন্য যথোপযুক্ত কোনো পদ থাকতে পারে না; অথবা বিদেশি দূতাবাসে; অথবা কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে? দয়া করে শিগগিরই কিছু একটা করুন, খুবই অসুবিধায় আছি।”
এর আগের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে হুমায়ুন কবিরকে আরেক চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন-
” আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না; আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু…কিন্তু ভাগ্য এমনই যে, তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়; সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।”
জীবনানন্দের ভয়ই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে। তিনি তার ভালো দিন দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর আগে ঘনিষ্ঠ যাকেই কাছে পেয়েছেন তাদের হাত জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘আমি কী একটাও এমন কবিতা লিখতে পেরেছি যার জন্য মানুষ আমাকে মনে রাখবে? বাংলা সাহিত্যে আমার নাম ভাস্বর থাকবে?’ কী আশ্চর্য! বাংলা সাহিত্যের সেরা আধুনিক কবির নিজেকে নিয়ে কী এক ভয়াবহ সংশয়! পকেটের দৈন্যদশা, সমাজের নিষ্ঠুরতা, পরিবার থেকে পাওয়া অপমান, সাহিত্যে অবহেলা আর পেটের ক্ষুধায় কবির আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকেছিল তলানিতে। জীবনানন্দ একজন পুরোদস্তুর কবি হয়েও লিখেছিলেন উপন্যাস ও কিছু প্রবন্ধ। কবিতা লিখে পয়সা কামানো যায় না এমন বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই জীবনানন্দ উপন্যাস লেখায় হাত দেন। কিন্তু তার উপন্যাসগুলো এতবেশি আত্মজৈবনিক ছিল যে জীবনদ্দশায় তা আর প্রকাশ করেননি জীবনানন্দ।
তার লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মাল্যবান’ নিয়ে জীবনানন্দ তার এক সময়কার সাবলেট বাসায় ভাড়াটিয়া অমল দত্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন-
“অমল আমার টাকা চাই। বাঁচার মতো টাকা চাই। আমার একটা অপ্রকাশিত উপন্যাস আছে। মাল্যবান। সেটার চিত্ররূপ দেয়া যায় না? আমি ভেবে পাই না আমার যারা বন্ধুবান্ধব আছে চিত্রজগতে, কাহিনিকার-চিত্রনাট্যকার-ডিরেক্টর, টাকা রোজগার করছে, তারা কেন তাদের দলে আমাকে ভিড়িয়ে নিচ্ছে না, বলতে পারো?”
আশপাশে নানা ধাচের স্বচ্ছল মানুষ; প্রকাশক, সমালোচক, নাট্যকার, কাহিনিকার- সবাই হয়তো জীবনানন্দকে চেনেন, কিন্তু নির্জনতম কবি ঠিক জানেন না আড্ডাটা কীভাবে জমাতে হয়, সম্পর্কটা কীভাবে উষ্ণ রাখতে হয়, কীভাবে নিজেকে মধ্যমণি করে নিজের স্বার্থখানা হাসিল করতে হয়। নিজের দোষের কথা কবি নিজের কবিতা ‘বোধ’ এ অকপটে শিকার করেছেন-
‘সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?’
জীবনের জমা-খরচের কোনো হিসাব মিলছে না জীবনানন্দের। তাইতো আক্ষেপে নিজের বোন সুচরিতা দাশকে লিখেছেন-
“এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। কোনো ইনকাম নেই একরকম। কোনো কলেজে এটাচ নেই বলে টিউশন পাচ্ছি না, লেখার বাজার খুব খারাপ। গল্প-উপন্যাস তবু খানিকটা বিক্রি হয়, কিন্তু প্রবন্ধ-কবিতার চাহিদা বা মূল্য কিছুই নেই…”
বুঝতে অসুবিধা হয় না জীবনানন্দ জীবনের এক পর্যায়ে কেন উপন্যাস লেখায় মননিবেশ করেছিলেন। মাল্যবান উপন্যাসটি এত বেশি আত্মজৈবনিক ছিল যে জীবনানন্দ ভক্ত ও গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ যখন সেটি প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন কবিপত্নী লাবণ্য দাশ বাধা দিয়ে বলেছিলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন জীবনানন্দ এ উপন্যাস প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। লাবণ্যের এই অনীহার কারণ উপন্যাসেই স্পষ্ট। চাকরি না থাকায় নিজের স্ত্রীর কাছে কতটা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, সংসারে কতটা অবহেলিত হয়েছেন, তা ফুটে উঠেছে মাল্যবান উপন্যাসে।
কতটা অসহায় হলে অপরিচিত মানুষের কাছেও অকাতরে একটি কর্মসংস্থানের জন্য হাত পেতেছেন জীবনানন্দ দাশ। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দী মহকুমার অনিল বিশ্বাস নামক এক ডেপুটি সেক্রেটারি জীবনানন্দ দাশকে বুক রিভিউয়ের জন্য চিঠি লিখে অনুরোধ জানালে প্রত্যুত্তরে জীবনানন্দ লেখেন- “…বইয়ের রিভিউ লেখা আমি অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি। ওদিক দিয়ে আমার কোনো যোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। যাহোক আপনার বই আমার কাছে রইল, যদি কিছু লিখে উঠতে পারি নিশ্চয় লিখব।…আমি আজকাল বড় মুস্কিলের ভিতর আছি, কাজ খুঁজছি, কলকাতায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, আপনি কি কিছু সাজেস্ট করতে পারেন?…”
একটা সময় নিজের লেখা নিয়ে জীবনানন্দের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না এ কথা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম জীবনের পত্রালাপেই প্রমাণিত। নিজের নামের সঠিক বানানের ব্যাপারেও জীবনানন্দ ছিলেন সচেতন। ধূর্জটিপ্রসাদ কিংবা ওয়ালীউল্লাহর মতো মানুষেরা যখন জীবনানন্দের নাম ভুল বানানে ‘জীবনান্দ’ লিখছিলেন, সেখানে জীবনানন্দকে নিজের আত্মপরিচয়ের শুদ্ধিকর হিসেবে দেখা গিয়েছিল। তাদের লেখা ফিরতি চিঠিতেই জীবনানন্দ লিখেছেন- তার নাম জীবানান্দ নয় বরং জীবনানন্দ।
জীবনের অনেক ক্রান্তিকালে নিজের পেটের দায় মেটাতে নিজের লেখার ওপরেই ভরসা করেছেন জীবনানন্দ। সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছেন-
“বেশ ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি ( এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব…টাকা এখুনি চাই…লেখা দিয়ে আপনাদের সব টাকা শোধ করে দেব…”
জীবনানন্দ চাকরি পেয়ে থিতু হতে পারলে আট-দশটা ছাপোষা বাঙালির মতো তার জীবনেও হয়তো স্বচ্ছলতা আসত। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে হয়তো সন্ধ্যাবেলা লুচি-সন্দেশযোগে সুখে দিন কাটত তার। কিন্তু কর্পোরেট আভিজাত্যের ভাঁজে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সবার অজান্তে একজন কবি হয়তো মরে যেতেন ট্রামে চাপা পড়ে মারা যাওয়ারও ঢের আগে। আর এই যে হাহাকার, না পাওয়া, অভাব, অবহেলা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা; কাব্যলক্ষ্মী বোধহয় কবিতা লেখার রসদ হিসেবেই জীবনানন্দকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এসব। তাইতো জীবনানন্দ লিখে গেছেন-
‘এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ’