উদ্যোক্তা বিশ্ব ডেস্ক
বাবা, বড় হয়ে কি হবা- ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার? শৈশবে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া আসলেই মুশকিল হবে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজ পর্যন্ত উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হতে কাউকে অনুপ্রাণিত করা হয় না। তবে দু’ একজনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে।
আমরা অনেকের মনের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার বা নিজে কিছু করার সুপ্ত বাসনা কাজ করে। নিজে মন-মেধা-পরিশ্রম দিয়ে কোনো ব্যবসা দাঁড় করাতে চান। কিন্তু সাহস করে শুরু করতে পারছেন না। তাদের জন্যই আজকের এই আয়োজন।
শুরুতেই বলা ভালো, ব্যবসা সবার জন্য নয়। কিন্তু আপনি যদি স্বাধীনচেতা চান, এখনও আয় করছেন তাহলে ব্যবসা আপনাকে চমৎকার একটি জীবন দিতে পারে। সময় ভাগ করে নিন। নিজে নিজেকে প্রশ্ন করুন, চেষ্টা করার জন্য তৈরি হন। আমরা প্রত্যেকেই সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কোনো না কোনো কাজে বা চাকরির পেছনে খরচ করি। এই সময়টুকু আপনি ভালোবাসেন বা করতে পছন্দ করেন এমন কোনো কাজে খরচ করতে পারেন। এমন কিছু করতে পারেন যা আপনার জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রভাব ফেলবে।
এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণের কথা বলা হলো যা পড়লে আপনার মনে হতে পারে প্রতিদিনের বেশ কিছুটা সময় নিজের পছন্দ অনুযায়ী ব্যয় করা যায়। চলুন দেখে নেয়া যাক সেই কারণগুলো:
১. নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ: আপনি যখন ৯টা-৫টার নিয়ম মেনে কাজ করে তখন আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের মালিক বা কোম্পানির অনুগ্রহের মধ্যে রয়েছেন। তারা আপনাকে নিয়োগ দিতে পারে, আবার চাকরি থেকে বরখাস্ত করেও দিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন প্রতিদিন আট ঘন্টা আপনি কিভাবে তাদের জন্য ব্যয় করবেন। এই আট ঘন্টা বাইরে আপনার ওপর তার কি প্রভাব পড়বে তারাই ঠিক করবেন। এতে আপনার খুব কমই নিয়ন্ত্রণ এবং আদান-প্রদানের বিষয়টি থাকে। কারণ তারা আপনাকে মাস শেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে পরিশোধ করে। আজকের সমস্যাটা আর্থিক। সুদীর্ঘ একটা সময় চাকরি করার পর আপনার হাতে পেনশন বাবদ কিছু টাকা তুলে দেয় কোম্পানি। বর্তমানে ব্যবসা নতুন একটি পেনশন পরিকল্পনা। আপনার উপার্জন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা নিশ্চয়ই অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে চান না।
২. সময় ব্যয় করার স্বাধীনতা: আমাদের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। সময় এমন একটি বিষয় যা একবার অতিক্রম করে গেলে আর কোনো দিনই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই সময়কে অমূল্য সম্পদ ধরা হয়। আমাদের এর সদ্ব্যবহার করা উচিত। ব্যবসা আপনাকে সময়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে।পরিবারের প্রয়োজনে বা নানা পরিস্থিতিতে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ঐ দিনটা কিভাবে ব্যয় করবেন। কিন্তু চাকরি করে এই স্বাধীনতা পাবেন না। আপনার কাজ জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া চাই, অন্যভাবে নয়। জীবনের গুরুত্বটাই সবার আগে। জীবনের জন্য অর্থ, অর্থের জন্য জীবন নয়।
৩. অগাধ আয়ের সুযোগ: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চাকরিতে বেতন প্রদান করা হয়। চাকরিতে বেতন বাড়তে পারে, পদোন্নতিও পেতে পারেন। কিন্তু এটি ব্যতিক্রম, আইন নয়। চাকরিতে আপনার আয় নির্দিষ্ট, তা যত সময়ই ব্যয় করেন না কেন। সত্যি কথা বলতে, আপনি ব্যবসা থেকে এক টাকাও আয় করতে পারবেন না; যদি না আপনি একজন স্বপ্রণোদিত উদ্যোক্তা হয়ে একটি লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা না করেন। উদ্যোক্তারা তাদের স্থিতিশীল অবস্থায় সুখী নয়। তারা ব্যবসা বিস্তৃত করে এবং আয়ের দিকে মনোযোগী হয়। উদ্যোক্তাদের নান্দনিকতা হচ্ছে, তাদের আয় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো দ্বাররক্ষক বা প্রতিবন্ধকতা নেই।
৪. স্থানের স্বাধীনতা: ব্যবসা করার সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারছেন। বর্তমানে পুরো বিশ্বে আড়াইশো কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তার মানে হচ্ছে, আপনার অগণিত গ্রাহক। ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের বালাই এখন নেই। এই ধরনের ব্যবসায়কে আপনি অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা বলতে পারেন।বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে আপনি এ ব্যবসা করতে পারেন। এতে আপনার আয়ে কোনো প্রভাব পড়বে না।
৬. দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করার সুযোগ: আপনি যখন আপনার স্বপ্নের ব্যবসাটি দাঁড় করাবেন তখন আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর থেকে সুবিধা ভোগ করতে পারবে। আপনার সন্তান, তাদের সন্তানেরা এই ব্যবসার সুবিধা ভোগ করতে পারবে। মোটর গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের কথা চিন্তা করুন। হেনরি ফোর্ড এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করলেও তার কয়েক প্রজন্ম এই ব্যবসা মুনাফা ভোগ করছে।
৭. ভাগ্যের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ: আপনার চেষ্টা ও সিদ্ধান্তের ওপর ব্যবসার সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অন্য কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
৮. উদ্যোক্তারা উদ্ভাবক: চিন্তা করুন গত কয়েক বছরে আমাদের জীবনে কত আধুনিক প্রযুক্তি পণ্য এসেছে। এর প্রতিটি এক একটি আইডিয়া। আর একজন চমৎকার উদ্যোক্তা এসব প্রযুক্তি পণ্য নিজের জীবনে কাজে লাগায়।
৯. জীবন পরিবর্তনের সুযোগ: একটি পণ্য বা সেবার আইডিয়া জীবনে ব্যাপক ফেলতে পারে। পুরো জীবনকেই ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারে। তাই আজই ভাবুন, নতুন কি করতে পারেন আপনি? দেখবেন সফল হতে কোনো কিছুই আপনার জীবনে প্রতিবন্ধক হতে পারছে না।
১০. আদর্শ: একজন উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে আপনার ওপর সবার নজর থাকবে। পরিবার, বন্ধু, কর্মচারী, সমাজের লোকজন সবার জন্য আপনি হবেন আদর্শ। তাদের জন্য আপনি হবেন অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ।
১১. বয়সের বাধা নেই: উদ্যোক্তাদের কোনো বয়স নেই। কেউ নয় বছরে উদ্যোক্তা হয়, আবার কেউ ৭০ বছরে। বিশ্বের সেরা ধনী ওয়ারেন বাফেট মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি শেয়ার ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
১২. প্রতিটি চিন্তাই কাজে লাগবে: ব্যবসার প্রতিটি সিদ্ধান্তই আপনাকেই নিতে হবে। এর সব দায়-দায়িত্ব আপনারই। ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে তা বাড়ানো, ব্র্যান্ডিং, প্রমোশন, লক্ষ্য নির্ধারণ সব সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।
১৩. শূন্য থেকে শুরু: প্রতিটি ব্যবসা শুরু হয় একটা আইডিয়া থেকে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয় একটি নতুন ব্যবসা, নতুন ধারণা।
১৪. পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ: উদ্যোক্তারা অন্যদের চেয়ে স্ত্রী-সন্তান বা মা-বাবার সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পান। পরিবারে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ খুব সহজেই করতে পারেন।
১৫. শখ পূরণ ও ফিট থাকা: কাজের সময় শতভাগ মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় ব্যয় করুন নিজের জন্য। আপনি ভালোবাসেন অথবা শখ এমন কোনো কাজ করতে পারেন। নমনীয় কর্মঘন্টা আপনাকে স্বাস্থ্যগতভাবে ফিট থাকতেও সাহায্য করবে। সকালে বা সন্ধ্যায় জিমে যেতে পারেন। পার্কে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।
১৬. সমাজে সরাসরি অবদান: একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গুণগত পণ্য বা সেবা সরবরাহ করে সমাজে অবদান রাখতে পারেন।
১৭. নিজেই নিজের বস বা মালিক: নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আপনার কোনো বস থাকবে না। কারো কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে না, অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ব্যবসার জন্য ভালো হবে এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত আপনি তাৎক্ষণিক নিতে পারবেন।
১৮. বড় স্বপ্ন দেখুন: কোনো আইডিয়াই পাগলামি নয়। আবার কোনো স্বপ্নই খুব বড় না– যখন আপনি একজন উদ্যোক্তা। ইচ্ছামতো স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা আপনার রয়েছে।
১৯. ভাগ্যবান হতে হবে না: কাজ শুরু না করেই অনেকেই আমরা নিজেকে ভাগ্যের ওপর সপে দেই। পরিশ্রমীরা ভাগ্যে বিশ্বাস করে না, ভাগ্য তৈরিতে বিশ্বাস করে। জীবনের সফলতার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকা। আর এটি অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
২০. গণমাধ্যমে স্বীকৃতি: আপনার কোম্পানি যখন গণমাধ্যমে ইতিবাচক স্বীকৃতি পাবে তখন আপনার আনন্দের সীমা থাকবে না। তখন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাড়াতে আপনার মনে দারুণ উৎসাহ তৈরি করবে।
২১. উচ্চ শিক্ষার দরকার হয় না: উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনাকে নামকরা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হয় না। বিশ্বের সব সফল উদ্যোক্তাদের জীবনী পড়লে দেখতে পাবেন, অধিকাংশ উদ্যোক্তা স্কুল বা কলেজ থেকে সিটকে পড়েছিলেন।