হ্লুবাইশু চৌধুরী চিত্রশিল্পী, মৃত্তিকা গাইন আলোকচিত্রী। দুজনই বয়সে তরুণ। একজন ক্যানভাসে এঁকেছেন বাংলাদেশের উঁচু ভূমি মানে পাহাড়ি আবহের ছবি। আরেকজন ক্যামেরায় তুলেছেন বাংলাদেশের উপকূলবর্তী সমতল; আরও খোলাসা করে বললে নিচু ভূমির ছবি। সৃজনশীল দুটি মাধ্যমে দুজন একটি বিষয়ই ফুটিয়ে তুলেছেন—জলবায়ুর পরিবর্তনে মানুষের জীবনযাপন, প্রকৃতি-পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যে প্রভাব।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কাছ থেকে দেখে, বলা ভালো অনুভব করে, নিজেদের সৃজনশীলতায় ফুটিয়ে তুলেছেন হ্লুবাইশু ও মৃত্তিকা। তাঁদের আলোকচিত্র ও চিত্রকর্ম নিয়ে রাজধানীর বনানীতে এশিয়াটিক সেন্টারের ছাদে বাতিঘরে হয়ে গেল ‘রাইজিং ইকোস’ শিরোনামের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি চলেছে গত ২০ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। আয়োজন করেছিল মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন।
ছাদে হওয়ায় বাতিঘরে ঢুকে প্রকৃতির ছোঁয়া ভালোই পাওয়া যায়। ডানদিকে সাজানো মৃত্তিকা গাইনের আলোকচিত্র, বাঁয়ে হ্লুবাইশু চৌধুরীর আঁকা ছবি। প্রদর্শনীর দুটি অংশের মাঝখানে যেমন দেয়ালের আড়াল নেই, তেমনি মৃত্তিকার ক্যামেরায় ধরা আর হ্লবাইশুর তুলিতে ফুটে ওঠা বিষয়ও যেন একাকার। প্রতিটি কাজে প্রকৃতির কান্না, মানুষের শেকড় ছিঁড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
মৃত্তিকা গাইনের তোলা ১৭টি ছবিই সাদাকালো। খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনা এলাকায় বেড়ে উঠেছেন মৃত্তিকা। পাশেই শিবশা ও ভদ্রা নদী–লাগোয়া কালাবগি এলাকা। এখানে দিনের পর দিন গিয়ে ছবি তুলেছেন মৃত্তিকা। সব একই অঞ্চলের ছবি। একটা জায়গার নাম ঝুলন্ত পাড়া। এমন নামের হেতু কী? মৃত্তিকা বলেন, ‘প্রাকৃতিক কারণে এলাকাটা নিচু হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় পুরো এলাকা ডুবে যায়। তাই এখানে সবাই মাচার ওপরে বাস করেন। জোয়ার–ভাটার সময় জায়গাটা ডোবে-ভাসে। এ কারণেই নাম ঝুলন্ত পাড়া। জলবায়ুর পরিবর্তনের জের হিসেবে কয়েক বছরের মধ্যেই এলাকাটা আর থাকবে না।’
একটা ছবিতে এক নারীর মুখাবয়বে শূন্য দৃষ্টি। ছবির চারদিকে হাতে লেখা ক্যাপশন। তা থেকে জানা গেল, একসময় এখানে প্রচুর মাছ, বিশেষ করে পোনা মাছ ধরতেন তিনি। এখন সেই মাছের সংখ্যা একেবারেই কম। দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে। মৃত্তিকা বলেন, ‘সিডর ও আইলা ঝড়ে এ এলাকার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে তত ভয়ংকর না হলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াশের কারণে ঝুলন্ত পাড়াটাই ভেঙে গেছে।’
২০১০ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন মৃত্তিকা গাইন। কিছুদিন পর তাঁর হাতে আসে শিল্পী এস এম সুলতানের আলোকচিত্র নিয়ে নাসির আলী মামুনের বই ‘গুরু’। মৃত্তিকা বলেন, ‘প্রথম বুঝতে পারলাম যে ছবি দিয়ে গল্প বলা যায়। আলোকচিত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম।’ এরপর আলোকচিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠশালায় একাধিক কোর্স করেন মৃত্তিকা। তিন বছর মেয়াদি পেশাদার কোর্সও করেছেন। আর চলেছে ছবি তোলা। নিজের আগ্রহ থেকে এখন চারুকলা নিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রদর্শনীর বাঁদিকে ঝোলানো আছে হ্লুবাইশু চৌধুরীর আঁকা ১০টা ছবি। এককোনায় একটি হেডফোন। সেটি কানে দিতেই ভেসে এল পাহাড়ি ঝরনার কুলকুল ধ্বনি। কিন্তু মাঝেমধ্যে গাছ কাটার কর্কশ শব্দ। উন্নয়নের জন্য পাহাড়ের স্বাভাবিক প্রকৃতি, সহজাত জীবনযাত্রার ওপর যেন কুঠারাঘাত। খাগড়াছড়ির মারমা সম্প্রদায়ের হ্লুবাইশু চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের পেইন্টিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। স্নাতক ডিগ্রিও নিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রদর্শনীর ছবিগুলো এঁকেছেন অ্যাক্রেলিক, জলরং ও কালি-কলমে। নিজের হাতে তৈরি কাগজেও তিনটি ছবি এঁকেছেন। হ্লুবাইশু বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র তুলে ধরে রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কথা ছবিতে বলার চেষ্টা করেছি। শুরুটা সেই ছয় দশক আগে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে।’ হ্লুবাইশুর প্রতিটি ছবিতেই ধরা পড়েছে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের বেদনা, প্রকৃতির সহজাত গতির পরিবর্তন। সাদা কাগজে লাল কালির কলমে আঁকা এক ছবি। আদতে সেটি সাজেকের মানচিত্র। সেই মানচিত্রে থাকা প্রতিটি ঘর-মাচা, বৃক্ষ, প্রাণী—সবই উল্টো। হ্লুবাইশু চৌধুরী বলেন, ‘পর্যটন প্রকল্পের নামে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সৌন্দর্যের পেছনে যে দুঃখ, সেটাই বড় কথা। সাজেক থেকে লুসাই, ত্রিপুরাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন যে লুসাই গ্রাম আছে, তা সাজানো গ্রাম। আসল গ্রাম তো উচ্ছেদ হয়ে গেছে।’
এ কারণেই হ্লুবাইশু চৌধুরীর ছবিতে পাহাড়ের মাথায় উৎকটভাবে সুইমিং পুল কিংবা সিংহাসন শোভা পেয়েছে। আবার উন্নয়নের বোঝা বহন করে পাহাড়ি নারী পাহাড় বাইছেন। পাহাড়ে অযাচিত উন্নয়নের নামে যে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেসবই ছবিতে উঠে এসেছে। প্রদর্শনীর কিউরেটর সামসুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের নিচু ও উঁচু দুই ভূমিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে। পাহাড়ে বিপর্যয় হয়েছে উন্নয়নের কারণে, আর সমতলে হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে দুটি বিপর্যয়ই মানুষের সৃষ্টি।’
মৃত্তিকা গাইন ও হ্লবাইশু চৌধুরী দুজনই দুটি এলাকার স্থানীয় মানুষ। যেখানে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে তাঁরা দেখেছেন। সামসুল আলমের কথায়, নিয়মিত তাঁরা ঘটনা দেখেছেন। সেটারই প্রতীকধর্মী উপস্থাপনা ছিল এই প্রদর্শনীতে।