১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে বিরোধী দলের সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এই দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ছয় দফা দাবি আনা হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদ সম্মেলন করে এর জবাব দেন।
বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ছয় দফায় কী আছে? ১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি: দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনই হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে ফেডারেল ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যথা-দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
৩. মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত যে-কোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে। ক. সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা, খ. বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবলমাত্র একটি মুদ্রা চালু থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পৃথক আর্থিক ও অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
৪. রাজস্ব, কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্যে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকম করের ক্ষমতা শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: ক. ফেডারেলভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে। খ. বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে। গ. কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে। ঘ. অঙ্গরাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধানিষেধ থাকবে না। ঙ. শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬। আঞ্চলিক বাহিনীর গঠন ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্যে শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার দাবি, ৬-দফা কর্মসূচি; প্রকাশক-আবদুল মোমেন, প্রচার সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থেকে সার সংক্ষেপ)
বঙ্গবন্ধু ছয় দফার আন্দোলন শুরু করেন ১৭ এপ্রিল যশোরে জনসভা থেকে। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘ওরা বলেন ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদ। ওরা জেনেশুনে মানুষকে ভুল বোঝায়। আমি আমার মানুষের অধিকার আদায় করতে চাই। আমি ছয় দফার পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা চেয়েছি। তা কি বিচ্ছিন্নতাবাদ? গ্রেট ব্রিটেনের ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে কি আলাদা সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা নেই? এমনকি স্কটল্যান্ডের আলাদা জাতীয় পতাকা নেই?’
পরদিন তার খুলনার জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা। সেদিন ১৮ এপ্রিল, তাকে গ্রেফতার করা হয়। উচ্চ আদালত তাকে জামিন দেন। সরকার তাকে আবার গ্রেফতার করে। এই খেলা চলতে থাকে বহুদিন। জুন মাসে ছয় দফার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ৭ জুন প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় ছয় দফার আন্দোলন। এই দিন ছয় দফার দাবিতে ঢাকা, তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জের রাজপথে নেমে আসা মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ তেজগাঁওয়ের মনু মিয়া। ওই দিন বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিবর্ষণে মোট ১১ ব্যক্তি শহীদ হন।
ছয় দফা প্রণয়ন সম্পর্কে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন : ‘কয়েকদিন পর মানিক মিয়ার ধানমণ্ডির বাসায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবি নিয়ে মধ্যরাতে গোপন বৈঠক বসে। এই বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ও মানিক মিয়া ছাড়াও নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, মোহন মিয়া, নান্না মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ৬ দফা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, নান্না মিয়া ও মোহন মিয়া দাবিগুলোর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। অন্যরা সেই মুহূর্তে দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলনে নামার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। শেখ মুজিব খসড়া প্রস্তাব আকারে দাবিগুলো যে কাগজে লেখা হয়েছিল সেটি তুলে নিয়ে বললেন, এই দাবিগুলো হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের ‘ম্যাগনাকার্টা’। এই দাবির সঙ্গে আমরা অন্তত আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। যদি আপনারা কেউ রাজি না হন তাহলে আমাকে একাই এই দাবি পেশ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে এবং আর কোনো দল না চাইলেও আওয়ামী লীগকে নিয়েই আমাকে আন্দোলনে নামতে হবে।’ (ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭-১৫১)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালির নিজস্ব আবাসভূমি হবে। বাঙালি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে তার রাজনীতি। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং নিপীড়নের বিষয়টি। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে লাহোরে পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের সভায় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা পেশ করেন, যা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ। সঙ্গে সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও শাসক মহলসহ সারা পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন নতুন করে গতি পায়। আসল সত্য হলো, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য ছয় দফা প্রণীত হয়নি। এক দেশে দুটি স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবহার প্রস্তাব করে শেখ মুজিব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
১৯৮৫ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে বাবাকে তখন খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। যদিও আজ (১৯৮৫ সাল) থেকে ২০ বছর আগের কথা তবুও মনে হয় স্পষ্ট দেখছি বাবাকে। খাবার টেবিলে যদি আমরা বাবাসহ খেতে বসেছি কিংবা দুর্লভ সব মুহূর্তে বাবাকে ঘিরে বসে গল্প শুনছি, গল্প করছি তখন হঠাৎ বাবা বলতেন, এখন চুপ; বল তো কী আমাদের প্রতিজ্ঞা? আমরা ট্রেনিংপ্রাপ্তের মতো চটপট ছয় আঙ্গুল তুলে বসে থাকতাম। বাবা খুশি হতেন। হ্যাঁ, এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাবা সংগ্রাম করেছেন ছয় দফার জন্য। অতএব, আমরা তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই সংগ্রামে শরিক হয়েছি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বাবা যখন খাবার টেবিলে খেতে বসতেন বা কথা বলতেন, তখন ছয় আঙ্গুল তুলেই পাঁচ আঙ্গুল সরিয়ে নিয়ে তিনি বলতেন, ‘এখন শুধু এক দফা।’ (সচিত্র সন্ধানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ১৯৮৫)।
ছয় দফাই শেষ পর্যন্ত এক দফার দাবিতে রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের মানুষের মুক্তিসনদ ম্যাগনাকার্টা আজ ৮০০ বছর পরেও সে দেশের গণমানুষের অধিকারের রক্ষাকবচ হয়ে টিকে আছে। ছয় দফাও তেমনি স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। এই রক্ষাকবচে হাত দেয়ার সাধ্য কোনো ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, আধিপত্যবাদী অশুভ শক্তির নেই।