বাংলা পঞ্জিকার নিয়ম অনুযায়ী, আজ ১ অগ্রহায়ণ। অনেক পালাবদলেও বাঙালির নবান্ন আজও পুরোপুরি মলিন হয়নি।
এই ‘ফসলি’ নামের সনটা প্রথম আধুনিকীকরণ করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাসদ ‘ফাতেউল্লাহ’।
অনেক গবেষকের মতে, সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনকে আধুনিকীকরণের আগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ।
অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থটাও অনেকটা তা-ই দাঁড়ায়।
মোগল আমলে কর তোলার সুবিধার কথা বিবেচনা করে বৈশাখ মাসকে বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কারণ, তৎকালীন কৃষকের বার্ষিক উৎপাদিত ফসলের কর তোলার সুবিধাজনক সময় ছিল বৈশাখ মাস। খটখটে শুকনা এ মৌসুমে ঘোড়ায় চড়ে যেকোনো কৃষকের বাড়িতে হানা দিয়ে কর আদায়ে সুবিধা পাওয়া যেত।
এ তো গেল সেই পুরোনো আমলের কথা। কালে কালে কৃষকদের আনন্দের সময় এই অগ্রহায়ণ মাস। কারণ, এ সময় তাঁদের ঘরে নতুন ফসল আসত, আসত সমৃদ্ধি।
জামাইবাড়ি ও নতুন কুটুমদের এই সময় নিমন্ত্রণ জানানো হতো নতুন চালের পিঠাপুলি, পায়েস খাওয়ানোর জন্য।
নতুন ধান উঠলে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে আনন্দ উৎসব হতো। কাঁচা খেজুরের রস, নতুন চাল ও গরুর দুধ দিয়ে পায়েস-ফিরনি তৈরি হতো। যার যার ধর্মমত অনুযায়ী সেই ‘নবান্ন’ শিরনি হিসেবে পাঠানো হতো কাছের দরগা, মসজিদ বা মন্দিরে।
সেই সমৃদ্ধি এখনকার কৃষকদের আর নেই। কখনো বন্যা, কখনো খরা-অতিবৃষ্টি-নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগী, সরকারি উদাসীনতা—এসব নানা কারণে কৃষকেরা ফসল উৎপাদনের প্রকৃত সুফল পাচ্ছেন না। শিল্পবিপ্লবের এই দাসত্বের যুগে কৃষি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।
এরপরও এই অগ্রহায়ণ মাসে হালকা শীতের আমেজ, পদতলে শিশিরের স্নিগ্ধ পরশ, ধূসর প্রকৃতি, ফসলশূন্য ধু ধু মাঠ, মন্থর সন্ধ্যা ও শিউলি ফুলের সুবাসে বাঙালির মন ভরে থাকে। মধ্যরাতে আকাশে দেখা মেলে ‘ড’ অক্ষরের মতো ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমণ্ডলীসহ অসংখ্য জ্বলজ্বলে নক্ষত্র।
দেশের কবি-সাহিত্যিকেরা হেমন্ত ঋতু নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা। এর মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ অনবদ্য। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উঠে আসে—‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে।’
রামপ্রসাদ সেন বলেছেন, ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না/এমন মানব জমিন রইলো পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা।’
কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর কবিতায় আশ্চর্য বাস্তবতায় দেখেন নবান্নকে—‘গণতন্ত্র ও সন্ত্রাস/একই বালিশে শুয়ে আছে/কার্তিকের হিমে/পাকা ধানের সুবাসে/নবান্নের উৎসবে…’।
এই উপমহাদেশের গণসংগীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ সুরকার ও শিল্পী সলিল চৌধুরী গেয়েছেন, ‘হেই সামালো, হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শাণ হো/ জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেবো না, আর দেবো না/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর কবিতায় আহ্বান জানান, ‘হে শীতের সূর্য! হে শীতের সূর্য!/ হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়/ আমরা থাকি/ যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ/ ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্য।’
নবান্ন ঘিরে যুগে যুগে কালে কালে অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে সারা দেশে। এরই ধারাবাহিকতায় এই নাগরিক জীবনে কংক্রিটের জঙ্গলে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নতুন প্রজন্মকে নবান্নের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছে জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ। এই পর্ষদ প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ ‘নবান্ন উৎসব’ আয়োজন করে আসছে। এ উৎসবে কৃষকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, জীবনাচরণ ফুটে ওঠে শিল্পীদের সংগীত, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, পাঠ ও বিশিষ্টজনদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
কৃষকের অনেক পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী বুলবুল মহলানবীশের কবিতার মতো করে বলতে চাই, ‘কে গো তুমি, মলিন কেন মুখ?/ কী হয়েছে, নাই কি মনে সুখ!/ এসো, হবে নবান্ন উৎসব/ সবাই মিলে খুশির কলরব।