চলাচলে বাধাহীন এক দৃষ্টিনন্দন সড়কে রূপ নিয়েছে রাজধানীর শেখ হাসিনা সরণি। মাঝে আট লেনের মূল সড়ক। দুই ধারে আরো ছয় লেনের পার্শ্ব সড়ক বা সার্ভিস রোড। সড়ক ঘেঁষে দুই পাশে খাল।
মূল সড়ক আর পার্শ্ব সড়কের মাঝে চওড়া সড়ক বিভাজক। তাতে সবুজের সমারোহ।
এটি রাজধানীর আরেকটি প্রবেশমুখ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে সড়কটির নামকরণের দাবিও ছিল নানা পর্যায় থেকে। সড়কটির দুই পাশের পূর্বাচলের মানুষজন মনে করছিল, বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সড়কটি আগামীর ঢাকার সড়ক হিসেবে নির্মিত হয়েছে। ফলে অনেকেই চেয়েছে এটি তাঁর নামে পরিচিত হোক।
বাধামুক্ত গাড়ি চলাচলের জন্য এই সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ইউ লুপ, আন্ডারপাস। এক লেন থেকে অন্য লেনে গাড়ি যেতে রয়েছে পাঁচটি ইন্টারসেকশন। এই সড়কের মাঝ বরাবর ওপর দিয়ে ভবিষ্যতে ছুটবে মেট্রো রেলও।
পশ্চিমের প্রগতি সরণি ও বিমানবন্দর সড়কের সঙ্গে পূর্বের ইস্টার্ন বাইপাসকে সংযুক্তকারী এই মহাসড়কটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় মহাসড়ক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকাল মঙ্গলবার এই সড়কের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরই মধ্যে দিয়ে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক।
এই সড়কের কোথাও গাড়ি থামার সুযোগ নেই। নেই কোনো গতিরোধক। আধুনিক এই এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো ধরনের স্টপওভারের জায়গা ও সিগন্যালের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। যে যার লেন মেনে ছয় থেকে আট মিনিটে পাড়ি দিতে পারবে সাড়ে ১২ কিলোমিটারের সড়কটি।
ঢাকার আরেক প্রবেশমুখ বাড়ল
বর্তমানে ঢাকা থেকে বের হওয়ার বা ঢাকায় প্রবেশ করার যে কয়টি পথ রয়েছে তাতে আরেকটি নতুন পথ যুক্ত হলো। এতে করে আঞ্চলিক সড়ক সেবার পাশাপাশি এই এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকাকে সিলেট ও চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করল।
এ ছাড়া ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক ও কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত আশপাশের এলাকাগুলোর নগরায়ণের কথা চিন্তা করলে রাস্তার ধারণক্ষমতাও বাড়ল। সঙ্গে নগরীর সৌন্দর্য, যোগাযোগব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলনে, প্রকল্পে খরচ বাড়লেও সড়কব্যবস্থায় একটি উন্নত সড়ক যুক্ত হলো। ভবিষ্যতে পূর্বাচল ও বসুন্ধরা আবসিক এলাকাকেন্দ্রিক অঞ্চলটি ঘনবসতিপূর্ণ হবে। তখন ওই অঞ্চলের মানুষজন সরাসরি এই সড়কের সুফল ভোগ করবে।
কী আছে দৃষ্টিনন্দন এই মহাসড়কে
প্রকল্পটিতে কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত ৫.৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আট লেনের মহাসড়ক, ছয় লেনের পার্শ্ব সড়ক (সার্ভিস রোড) রয়েছে। আর বালু নদী থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত ৬.৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে ও ছয় লেনের পার্শ্ব সড়ক রয়েছে।
উন্নত সড়কের পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত সড়কের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্টিলের পদচারী সেতু (ফুট ওভারব্রিজ) নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে ১২ কিলোমিটারের পুরো সড়ক ও খাল ঘিরে কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত তিন মিটার প্রশস্ত হাঁটার জায়গা রয়েছে।
প্রকল্পে কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত খালের দুই পাশে উত্তর দক্ষিণ বরাবর ১৩টি ‘ব্রিজ ওভার ক্যানেল’ নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো প্রকল্প এলাকায় প্রায় দেড় লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এর দুই পাশে থাকছে বসুন্ধরাসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা থেকে যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা।
ছয়টি আন্ডারপাস, ৩৬.৮ কিলোমিটার হাঁটার জায়গা, ১২.৫ কিলোমিটার সীমানাপ্রাচীর, এক হাজার ১৭০টি সড়কবাতি এবং ১১টি সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়েছে এই প্রকল্পে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্ব পেয়েছে খাল
শুধু আধুনিক একটি সড়ক নির্মাণ করার জন্যই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্ষায় ঢাকায় জলাবদ্ধতা বড় একটি সমস্যা। ঢাকার জলজট নিরসনেও বড় ভূমিকা রাখবে খাল ও নদীকেন্দ্রিক এই সড়ক প্রকল্প।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এক দিনের বৃষ্টিতে চার লাখ গ্যালন পানি জমা হলেও কোনো সমস্যা হবে না। প্রকল্পে মূল লেন তৈরি ছাড়াও সংস্কার করা হয়েছে ডুমনী, বোয়ালিয়া ও এডি-আট খাল। নির্মাণ করা হয়েছে ১০টি বড় সেতু।
প্রকল্পের নথিতে বলা হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে কুড়িল, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, ঢাকা সেনানিবাস, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাগুলোতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা এবং ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী, ডুমনী, বোয়ালিয়া ও এডি আট খাল বহমান রাখা ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করাও প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
১০০ ফুট খালের জন্য ৯০.১৫ একর, বোয়ালিয়া এবং ডুমনী খালের জন্য ৯৪.৬৪ একরসহ মোট ১৮৪.৭৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এই প্রকল্পে। একই সঙ্গে পুরনো প্রকল্পে মোট ২৬ কিলোমিটার লেক খনন করা হয়। আর প্রকল্পের মধ্যে নিকুঞ্জ খাল খনন ও উন্নয়ন (৭৫০ মিটার দীর্ঘ) করা হয়েছে।
যদিও নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলনে, এখানে আর প্রাকৃতিক খাল রাখা হয়নি। সব কৃত্রিম খালে পরিণত করা হয়েছে। ফলে এই খালের পানি শোষণের ক্ষমতা বেশি থাকবে না।
এ প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।