সাহিত্যে চারটি নোবেল, পাঁচটি বুকার পুরস্কার আর অতীত-বর্তমান মিলিয়ে এক ঝাঁক সাহিত্যিকদের মিলনমেলা এই ডাবলিন। জেমস জয়েস কিংবা স্যামুয়েল ব্যাকেট থেকে শুরু করে কম টয়বিন বা স্যালি রুনির মতো নামজাদা সব সাহিত্যকরা বেড়ে উঠেছেন ডাবলিনের আলো-হাওয়া গায়ে মেখে।
এতে করে অনেকেই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ডাবলিনের মাটিতে কিংবা জলে কী এমন আছে যে এখানে বাঘা বাঘা সব সাহিত্যিক জন্ম নিচ্ছেন? কী এমন অলৌকিক ক্ষমতায় পৃথিবীর সেরা গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিকরা ডাবলিনে নিজেদের অবস্থানকে বিশ্বব্যাপী জানান দিচ্ছেন?
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইরিশ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে শুধু ডাবলিনেই কী বড় বড় সাহিত্যিক জন্ম নিচ্ছেন, নাকি এটি আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা যা লেখকদের বিশ্বের বুকে জনপ্রিয় করে তুলছে?
তাহলে দেখা যাক আয়ারল্যান্ড সরকার নিজেদের সাহিত্যকদের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য কী কী করেন। আয়ারল্যান্ডের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ডাবলিন লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড যার অর্থমূল্য ১ লাখ ইউরো, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ। বিশ্বের সবচেয়ে দামী সাহিত্য পুরস্কার এটি। যেখানে বুকার প্রাইজের অর্থমূল্য ৫০ হাজার পাউন্ড সেখানে ডাবলিনের এ পুরস্কারই প্রমাণ করে সে দেশের সরকার আর যা হোক সাহিত্যের পেছনে টাকা ঢালতে কার্পণ্য করেন না।
এতো গেল পুরস্কারের কথা। এ ছাড়া নতুন লেখকদের অর্থ সহায়তা দেয়া, ভালো লেখকদের বই বিশ্ববাজারে মার্কেটিং করা ও তথাপি লেখালেখিকে একটি গ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় জুড়ি নেই ডাবলিনের। উপমহাদেশে কেউ লেখক হতে চাইলে যেখানে একশবার অন্নসংস্থানের কথা ভাবতে হয় কিংবা লেখক হয়ে গেলে আজন্ম অভাবী তকমা নিয়ে মরতে হয়, সেখানে ডাবলিনের লেখকদের জন্য সবরকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে আয়ারল্যান্ড।
নানা রকমের পুরস্কার ও অর্জন দিয়ে ডাবলিনের ঋণ শোধের পাশাপাশি, এসব লেখকদের কল্যাণেই ২০১০ সালে ইউনেস্কো ডাবলিনকে সাহিত্যের শহর বলে ঘোষণা দেয়।
এক সময় আয়ারল্যান্ড ছিল ক্যাথলিক চার্চের কড়া শাসনে বাধা একটি দেশ। সেখানে চার্চ কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে গেলে বার কয়েক সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। জেমস জয়েস ও স্যামুয়েল ব্যাকেটের মতো সাহিত্যিকরা ডাবলিন ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই ডাবলিন এখন আর্ট কাউন্সিলে দেদারসে পয়সা ঢালে, লেখকদের নিজেদের ইচ্ছামতো লিখতে দেয়, এমনকি লেখক সংঘকে করের আওতামুক্ত পর্যন্ত রাখে।
আয়ারল্যান্ড যুদ্ধ দেখেছে, দেখেছে দুর্ভিক্ষ। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ এই ৭ বছরে ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আয়ারল্যান্ডে ১০ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। ক্ষুধা, মৃত্যু ও রক্তের মিছিলের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে আয়ারল্যান্ডের লেখক শ্রেণি। বিংশ শতকের শুরুতে নোবেল বিজয়ী আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস আয়ারল্যান্ডকে বলেছেন একটি মোমের বল; যেভাবে খুশি আয়ারল্যান্ড আকৃতি দেয়া যায়।
মোমের বলের মতো আয়ারল্যান্ড ও শহর ডাবলিনকে সাহিত্যিকরা গড়ে তুলেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ইতিহাসের রক্ত, নৃশংসতা আর বর্তমানের কাব্য, ছন্দ ও আনন্দের মিশেলে ডাবলিন এখন সাহিত্যের রাজধানী ও উঠতি অনেকের জন্য অনুকরণীয়ও বটে।