ছোট বোন নুবাহকে নিয়ে একদিন ঘুরতে বেরিয়েছেন নাফিজা আনজুম। পথে একটা খেলনার দোকান পড়ে। বোনের আগ্রহ দেখেই দোকানটিতে ঢুকেছিলেন নাফিজা। কিন্তু একটি খেলনা পছন্দ করেও কিনতে রাজি হলো না নুবাহ। ছোট্ট মেয়েটার যুক্তি, ‘টাকা নষ্ট করার দরকার নাই। সেলামির টাকা জমিয়ে পরে কিনব।’ অবাক হয়ে নাফিজা ভাবছিলেন, ৯ বছরের ছোট্ট বোনটা কবে এত হিসেবি হয়ে গেল! সামান্য কটা টাকার জন্য তাকেও কেন চিন্তা করতে হবে! সেদিন থেকেই নাফিজার মধ্যে একটা জেদ চেপে বসে, নিজের অবস্থা বদলের জন্য একটা কিছু করতেই হবে।
সেই ঘটনার ৩ বছর পর, গত ২৫ জুন মেসেঞ্জারে নাফিজা আমাদের বলছিলেন, ‘সেদিন ওই ঘটনা যদি না ঘটত, তাহলে হয়তো আমার ভেতর জার্মানি আসার জেদ চাপত না। বা আমি কখনোই আউডিতে চাকরি করতে পারতাম না।’
আউডিতে স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন নাফিজা। সেই সুবাদে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আউডির মিডিয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁকে বসতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন নাফিজা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে ভর্তি হন। শুরুটা সেখানে হলেও শেষ করতে পারেননি। বাবার অসুস্থতা, পারিবারিক নানা অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা জেঁকে ধরেছিল। তবে হাল ছাড়েননি। সে সময় নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন এবং বাকি পড়াশোনা জার্মানিতে করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২১ সালের কোভিডকালে এইচটিডব্লিউ-বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের সুযোগ পান তিনি। সেখানে এক বছর অনলাইনে পাঠ নিয়ে ২০২২ সালের এপ্রিলে জামার্নির বার্লিন শহরে পাড়ি জমান।
বার্লিনে আসার সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত, তখন থেকেই বড় কোম্পানিগুলোতে চাকরির সুযোগ খুঁজছিলেন নাফিজা। পেশাদারদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনের মাধ্যমে আউডির বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপকের নাগালও পেয়ে যান। তাঁকে আগ্রহ ও উৎসাহের কথা জানাতেই ইতিবাচক সাড়া পান। কোভিড ও ভিসা জটিলতায় নাফিজার সেবার আউডিতে যোগ দেওয়া হয় না।
নাফিজা বার্লিন যাওয়ার পর সেই ব্যবস্থাপক নিজেই যোগাযোগ করেন। আবারও চাকরির প্রস্তাব দেন। এবার আর সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। তখনই আউডিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নাফিজা।
আউডিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিষয়ে নাফিজা আনজুম বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম বড় অটোমোটিভ কোম্পানিতে চাকরি করতে পারাটা সত্যিই দারুণ একটা ব্যাপার। আমি খুবই গর্বিত যে এমন একটা অগ্রগতিশীল কোম্পানিতে কাজ করছি, যেখানে বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমার বিভাগে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি।’
জার্মান সংস্কৃতি বা ভাষা, কোনোটাতেই অভ্যস্ত ছিলেন না নাফিজা। একদিকে জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, অন্যদিকে বাংলাদেশি হিসেবে নিজের পরিচয়টাও তুলে ধরা-কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। তিনি বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত, আউডিতে আমার সহকর্মীরা খুবই বন্ধুসুলভ। তা ছাড়া জার্মান ইউনিভার্সিটিতে পড়ি বলে দেশটার, কিংবা গোটা ইউরোপের সংস্কৃতি সম্পর্কেই মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে। ফলে আউডিতে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছে।’
নাফিজা ১৫টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছিলেন। ১১টি তাঁকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকে। এই ১১টির ৮টি থেকেই অফার লেটার পেয়েছিলেন। অথচ এখনো তাঁর স্নাতক শেষ হয়নি। এ বছর শেষ হবে বলে জানালেন। নাফিজা বলেন, ‘নিজেকে প্রশ্নটা করা প্রয়োজন, কোম্পানির উন্নতির জন্য আমি কী ভূমিকা পালন করতে পারি? কারিগরি দক্ষতা ও যোগ্যতা যেমন জরুরি, একইভাবে প্রয়োজন সফট স্কিল। মুখের ভাষা, শরীরী ভাষা ও মনোভাবও দৃঢ় প্রভাব ফেলে। সুতরাং, পেশাদারি মনোভাব, শেখার আগ্রহ ও কোম্পানির সঙ্গে বেড়ে ওঠার ইচ্ছা—এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’